Monday, January 14, 2019

সম্পূর্ণ ফ্রিতে খাবার পাওয়া যায় যে হোটেলে

বিনামূল্যে খাবারের হোটেল! এমন কথা শুনলে অবাক হওয়ারই কথা। বর্তমান যুগে এমন ঘটনা সত্যিই বিরল। কিন্তু ক’জন এমন দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পেরেছেন তা অজানাই থেকে যায়। 



যিনি এমন দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেছেন তিনি হলেন মরহুম আকবর আলী মিঞা। বিনামূল্যে খাবারের হোটেল তৈরি করে তিনিই দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেছেন।সারাদিন হোটেলে উন্নতমানের খাবার বিক্রি করার পর রাতে গরিব, ভিক্ষুক, ভাসমান ছিন্নমূল ও অভাবী মানুষদের মুখে বিনামূল্যে খাবার তুলে দেয়ার নজির স্থাপন করে আসছে সেই বগুড়ার আকবরিয়া গ্র্যান্ড হোটেল।হোটেলটির প্রতিষ্ঠাতা মরহুম আকবর আলী মিঞা। তার হোটেলে বিগত একশ’ বছরেরও বেশি সময় ধরে প্রতি রাতে দরিদ্র মানুষদের বিনামূল্যে খাবার দিয়ে আসছে। ভবিষ্যতেও এ ধারা চলবে বলে জানিয়েছেন হোটেল কর্তৃপক্ষ৷ 

আগের নির্দেশনা অনুযায়ী হোটেলটির কার্যক্রম চলছে। ভবিষ্যতেও এভাবেই চলবে।হোটেলটি বগুড়া শহরের কবি কাজী নজরুল ইসলাম সড়কে অবস্থিত। হোটেল কর্তৃপক্ষ দীর্ঘ ৯৬ বছর ধরে শহরের ভিক্ষুক, গরিব, ভাসমান, ছিন্নমূল ও অভাবী মানুষকে বিনামূল্যে খাবার বিতরণ করে আসছে। শহরের নাম-পরিচয়হীন মানুষদের একবেলা ভালোমানের খাবারের ব্যবস্থা করে থাকে হোটেল কর্তৃপক্ষ।

একেবারে আলাদা রান্না করে খাবার বিতরণ করা হয়। এ খাবারের জন্য প্রতিদিন শহরের অভাবী মানুষ হোটেলে ভিড় করে থাকে। বিনিময়ে কোনো শ্রম বা দাম নেয়া হয় না।অভাবী মানুষদের খাবার বিতরণ করে মরহুম আকবর আলী মিঞা এক অনন্য দৃস্টান্ত স্থাপন করে গেছেন। প্রায় শত বছর ধরে এ ধরনের সেবামূলক কাজ করে আসছে আকবরিয়া গ্র্যান্ড হোটেল কর্তৃপক্ষ।জানা গেছে, আকবরিয়া গ্র্যান্ড হোটেলের প্রতিষ্ঠাতা মরহুম আকবর আলী মিঞা তৎকালীন ভারতের মুর্শীদাবাদ জেলায় জন্মগ্রহণ করেন। ভাগ্য অন্বেষণে সপরিবারে বাংলাদেশের পাকশী, সান্তাহার এবং পরে বগুড়ায় আসেন।

আকবর আলী মিঞা ভাইয়ের সঙ্গে মেকানিকের কাজ শুরু করেন। ওই সময় বগুড়া শহরে মুসলমানদের খাবারের কোনো হোটেল ছিল না। হিন্দু সম্প্রদায়ের হোটেলে মুসলমানরা যেত না। হিন্দুরা তাদের হোটেলের আসবাব মুসলমানদের ছুঁতেও দিত না।এ থেকেই হোটেল দেয়ার চিন্তাভাবনা শুরু করেন আকবর আলী মিঞা। কিন্তু হোটেল দেয়ার মত তার প্রয়োজনীয় অর্থ ছিল না। হোটেল করার জন্য তিনি মিষ্টি তৈরি করে ফেরি করে বিক্রি শুরু করেন। 

মিষ্টি বিক্রির পুঁজি নিয়ে শহরের চকযাদু রোডের মুখে মাসিক ৮ টাকা ভাড়ায় হোটেলের ব্যবসা শুরু করেন তিনি।বগুড়া শহরে সে সময় আকবর আলীর ছোট্ট পরিসরে হোটেল ছিল। মুসলমানদের একমাত্র খাবার হোটেল এটি। 

হোটেলের নাম-ডাক খুব দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। বগুড়ায় সে সময় মুসলমানদের সংখ্যা বেশি হওয়ায় সেখানে খদ্দেরের স্থান সংকুলান হতো না। পরে তিনি শহরের (বর্তমান) থানা রোডে হোটেলটি স্থানান্তর করেন। সে থেকেই আকবরিয়া গ্র্যান্ড হোটেল হিসেবে পরিচিতি পায়।চল্লিশ থেকে ষাটের দশক পর্যন্ত তিনি তার হোটেলে মাসিক ১৫-২০ টাকায় তিনবেলা খাবারের ব্যবস্থা করে দিতেন। সে সময় ঘি দিয়ে রান্না করা বিরিয়ানির দাম ছিল ১ টাকা প্লেট। বিদ্যুৎ না থাকলেও তিনি নিজস্ব জেনারেটরে বিদ্যুতের ব্যবস্থা করেছিলেন।বগুড়ার সাদা সেমাইয়ের যে কদর দেশব্যাপী ছিল, তার মূলে ছিলেন আকবর আলী।

 সে সময় কলকাতা থেকে সেমাই আসতো বাংলাদেশে। এ অঞ্চলের মুসলমান বা সাধারণ মানুষকে অল্প দামে সেমাই খাওয়ানোর তাগিদে সেমাই তৈরি করেন তিনি। তাতে সফলও হন।ধর্মভীরু মানুষ আকবর আলী ব্যবসায় উন্নতি এবং প্রসারে ব্যাপক সফলতা পান। সৃষ্টিকর্তার ওপর বিশ্বাস রেখে আয়ের একটা অংশ দিয়ে প্রতিদিন রাতে ফকির-মিসকিনদের খাওয়াতেন তিনি। সেটা তিনি মৃত্যুর আগ পর্যন্ত করে গেছেন।

১৯৭৫ সালে মৃত্যুর আগে তিনি ছেলেদের হোটেলের আয় থেকে ফকির, মিসকিন, গরিবদের খাওয়ানোর নির্দেশ দিয়ে যান। আজও সে কথার এতটুকু নড়চড় হয়নি। পিতার আদেশ মেনে তার ছেলেরা আজো তা পালন করে যাচ্ছেন।আকবরিয়া গ্র্যান্ড হোটেলের এখন চারটি শাখা শহরেই। কবি নজরুল ইসলাম সড়কে আকবরিয়া গ্রান্ড হোটেল, ইয়াকুবিয়ার মোড়স্থ মিষ্টি মেলা, কোর্ট চত্বরে হোটেল অ্যান্ড রেস্টুরেন্ট ও শজিমেক হাসপাতালে হোটেল অ্যান্ড রেস্টুরেন্ট। 

এসব শাখায় সংযোজন করা হয়েছে আবাসিক, বেকারি, চাইনিজ, থাই ও ফাস্টফুড, লাচ্ছা-সেমাই, দই। কর্মচারী রয়েছেন অন্তত সহস্রাধিক। আকবর আলীর সেই লাচ্ছা-সেমাই এখন দেশের গণ্ডি পেরিয়ে বিদেশেও রফতানি হয়।বগুড়া শহরে ভিক্ষা করা ধুনট উপজেলার বৃদ্ধা ছমিরন নেছা সারাদিন ভিক্ষা করে রাতে আকবরিয়া হোটেলের খাবার খেয়ে স্টেশনের পাশে একটি ছোট্ট ঘরে থাকেন। ১৮-১৯ বছর ধরে রাতে আকবরিয়া হোটেলের খাবার খেয়ে যাচ্ছেন তিনি।

৬৫ বছরের বৃদ্ধ রমজান আলী বেপারী আয় রোজগার করতে পারায় আকবরিয়া হোটেলের খাবার খেয়ে থাকেন।মরহুম আকবর আলী মিঞার ছোট ছেলে ও আকবরিয় গ্রুপের পরিচালক মো. হাসান আলী আলাল বাবার নিয়ম পালন করে যাচ্ছেন। প্রতিদিন এক মণেরও বেশি চাল আলাদাভাবে রান্না করে খাবার বিতরণ করা হচ্ছে। 

রাত ১১টা থেকে ১২টার মধ্যে হোটেলের সামনের রাস্তায় খাবার বিতরণ করা হয়।১৯১৮ সালের আগে আকবর আলী মিঞা প্রথম গরিব মানুষের খাবারের ব্যবস্থা করেন। সেই থেকে আজ পর্যন্ত বাবার নিয়ম পালন করে যাচ্ছেন তার ছেলে।লত খাবার বিতরণ শুরু হয়েছিল মুসাফিরদের জন্য। কালক্রমে মুসাফিরের জায়গায় এখন দীনহীন মানুষকে খাবার দেয়া হচ্ছে। এখান থেকে যে কেউ খাবার নিতে পারে।

No comments:

Post a Comment